তাহেরার বিজয়
রাত ১ টায় মদ্যপান করে পাড়াময় শোরগোল করে বাড়ি ফিরলেন সাজেদ মিয়া। এলাকায় তার পূর্ব পুরুষের বেশ নাম-ডাক থাকলে তিনি তার বংশের জন্য কোনো সুনাম বয়ে আনেন নি। বছরে ছয় মাস থাকে বাড়িতে মাতাল হয়ে তো ছয় মাস থাকে জেলে! বাবা-মা মারা যাবার পর সাজেদ মিয়া জায়গা-জমি সব বিক্রি করে পথে বসার উপক্রম। তার একটা মাত্র মেয়ে তাহেরা। ছোটবেলা থেকেই বাবা-মায়ের অশান্তি, মাতাল বাপের মাতলামি, তাহেরার মায়ের উপর সাজেদ মিয়ার মর্মান্তিক নিত্যদিনের অত্যাচার আর বাপের দুদিন পর পর জেলে যাওয়া, এসব দেখতে দেখতে বড় হয়েছে তাহেরা।তাহেরার দুচোখ ভরা স্বপ্ন! জানালার ফাঁক দিয়ে যে জগৎ দেখে, উড়াল দেবার স্বপ্ন দেখে। তাহেরা এই অসুস্থ জীবন থেকে বের হতে চায়, পড়তে চায়, চাকরী করে মাকে নিয়ে সাজেদ মিয়া থেকে অনেক দূরে থাকতে চায়। সাজেদ মিয়ার প্রতিদিনের এই অত্যাচারে তাহেরা আর তার মা রাহেলা দুজনই ভীত হয়ে থাকে সর্বক্ষণ। তাহেরার খুব ইচ্ছে হয় পালিয়ে যেতে। তাহেরা ধীরে ধীরে যৌবনে পা দেয়, শরীরে যৌবনের ঢেউ সুস্পষ্ট। পাশের এলাকার এক ছেলে রিজভি, তাহেরাকে খুব পছন্দ করে, তাহেরা ভয় পায় ভাবোবাসতে, ভয় পায় এটা ভেবে যদি তার জীবনটাই তার মায়ের মতন হয়! তার জীবনেও যদি তার বাবার মতন মানুষ আসে! তাহেরার ঘুম আসে না। প্রণয়ের অনুভূতি আর ভয়ের সংমিশ্রণ তাহেরার মনকে প্রতিনিয়ত আন্দোলিত করে। তাহেরা না চায়তেও একটু একটু করে রিজভির মায়াতে আটকে যেতে থাকে, দিন-দুনিয়া বাস্তবতা কোনো কিছুই যেন তাহেরার মাথায় আসে না!
এইচ. এস. সি পাশের তাহেরা পালিয়ে বিয়ে করে করে রিজভিকে। শুরু হয় নতুন অধ্যায়। এইদিকে মেয়ে পালিয়ে বিয়ে করার অপরাধে দিন-রাত স্বামীর কাছে মার খেতে হয় রাহেলা বেগমের । বিয়ের কয়েক মাস পর থেকেই তাহেরা আবিষ্কার করে রিজভি কে নতুনভাবে। বেকার , ভবঘুরে বাবা-মায়ের অবাধ্য সন্তান রিজভির জীবনে কোনো লক্ষ্য নেই, ভাবনা নেই, এমনকি তাহেরাকে নিয়েও না! তাহেরা জানতে পারে রিজভির জীবনে সেই প্রথম নারী নয়! তাহেরা সব ভুলে রিজভিকে নিয়ে ভালো থাকতে চায়, সংসারটা সাজাতে চাই কিন্তু পেরে ওঠে না! তাহেরা পড়াশোনা করতে চায়, নিজেকে স্বাবলম্বী করতে চায়। রিজভি তা হতে দিবে না, তাহেরাকে সে চার দেওয়ালে আটকে রাখতে চায়, তাহেরা পড়াশোনা করুক, চাকরী করুক এসব কিছুই রিজভি হতে দেবে না। তাহেরা কেবলই রিজভির কাছে কাঠের পুতুল প্রায়! রিজভির প্রয়োজনে, যৌবনের তাড়নায় তাহেরাকে সে ব্যবহার করে মাত্র তাছাড়া রিজভির মগজের কোথাও তাহেরা নেই। তাহেরা যে রিজভিকে বিয়ে করে ভুল করেছে সেটা বুঝতে আর বাকি থাকে না কিন্তু তাহেরা সংসারটাকে সুস্থ-সুন্দর করে তুলতে চায়। দিনের পর দিন এই অত্যাচারগুলোতো তার চিরচেনা, সব যেনেও আবেগে সে কত ভল একটা পদক্ষেপ নিয়ে নিল। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায় তাহেরার জীবন আরও করুণ থেকে করুণতর হয়। মানুষ যেমনতিন বেলা করে ভাত খায় তাহেরা তেমন নিয়ম মাফিক মার খায়, রিজভির সন্দেহবাতিকতা আছে, সে অকারণেই তাহেরাকে চরিত্রহীন ভাবে, তাহেরার প্রতি শারীরিক ও মানসিকভাবে সে পৈশাচিক নির্যাতন করতে থাকে দিনের পর দিন। তাহেরা তার বেঁচে থাকাটা কে অভিশাপ মনে করতে থাকে, সে সিদ্ধান্ত নেয় আত্মহননের! শেষবারের মতন রিজভি যখন তার শরীর ভোগ করে তৃপ্ত না হতে পেরে চুলের মুঠি ধরে প্যান্টের বেল্টটা খুলে মেরে চলে গেল তখনই তাহেরা সিদ্ধান্ত নিল সে আজ নিজেরে শেষ করবেই! যখনই সে আত্মহনন করতে যাবে ঠিক তখনই তার মনে কিছু কথা আনাগোনা করলো! তাহেরার মনে হলো কেন সে নিজেকে শেষ করতে চাইছে? কার জন্য সে নিজেকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে নিতে চায়? উত্তরে যখন এলো রিজভি এবং রিজভির সাথে বেড়ে ওঠা এই ক্রমাগত ভয়ানক জীবন ঠিক সেই মুহূর্তে তার এটাও উপলব্ধি হল রিজভির মতন মানুষের জন্য কেন সে তার জীবন শেষ করবে! অন্যায়টা যার, শাস্তিটাও তারই পাওয়া উচিৎ, রিজভি বা তার বাবার মতন মানুষের এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। তাহেরা সিদ্ধান্ত বদলায়, ছুটে যায় থানায়। রিজভির নামে রিপোর্ট লেখায়,রিজভিকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়, তাহেরা মুক্ত, স্বাধীন অনুভব করে। তাহেরা তার মায়ের কাছে যায়, মাকে নিয়ে সে অনেক দূরে পালিয়ে যাবার কথা বলে, রেহানা বেগম সাহস পায় না। তাহেরা নিজেও ভাসমান, আসলেই তো! কোথায় যাবে তারা, কার কাছে যাবে! তাহেরা মাকে বলে, তার বাবাকে তালাক দিতে। রেহানা বেগম ঠাস করে তাহেরার গালে একটা থাপ্পর বসিয়ে কেঁদে দেয়। তাহেরা তবুও বলতে থাকে একই কথা। দিন যেতে থাকে সবকিছুই স্বাভাবিক হতে থাকে। তাহেরার বাবা মারা যায় হঠাৎ করে গাড়ি এক্সিডেন্ডটে। শুরু হয় তাহেরা আর তার মায়ের জীবনের নতুন লড়াই। তাহেরা পড়াশোনা করতে আরম্ভ করে, সংসার সামলাতে শুরু করে। বাবা মায়ের টাকার জোরে রিজভি ছাড়া পেয়ে যায়। শুরু হয় তাহেরা জীবনে আবারও অত্যাচারের অধ্যায়। তাহেরা আর মেনে নিতে পারে না, তার আত্মসম্মানে প্তিদিন ঘায়েল করতে থাকে রিজভি, এলাকা জুড়ে তাহেরার নামে বদনাম রটিয়ে দেয়, পুরো এলাকা তাহেরা ও তার মাকে নিয়ে ছি, থু করতে থাকে। তাহেরা এসব কে উপেক্ষা করতে পারে না। তার মনে হয় পালিয়ে যেতে অনের দূরে, কিন্তু তাহেরা তো পালানোর মতন কোনো দোস করে নি। তাহেরা এসবের মাঝে, এতোকিছুর পর ও হাল ছাড়েনি। রিজভিকে সে তালাক দেয়, রিজভির নামে সে আবারও মামলা করে। রিজভির জীবন হতে তাহেরা বিদায় নিয়ে চলে আসে একেবারে! তাহেরার এই মুহূর্ত বিজয়ে মুহূর্ত, তাহেরা মুক্ত পাখি হয় তার স্বপ্ন বুনবে। জীবনে এই আঁকা বাঁকা পথ তাকে শিখিয়েছে কিভাবে নিজের সত্তা খুঁজের পাওয়া যায়।