
প্রবন্ধ
উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রাঃ শ্রেষ্ঠত্বে অনন্য
-মুফতি সাদিকুর রহমান খাদিমানী
মহান আল্লাহ সিদ্দীকে আকবর তনয়া আম্মাজান হযরত আয়েশা (রা.) কে তাঁর প্রিয় হাবীব নূর নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মহা সম্মানিতা স্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করেছেন। যদিও মহানবীর সম্মানিতা স্ত্রী হবার সৌভাগ্য নারী জাতির কয়েকজনের হয়েছিল তবে ব্যতিক্রমী মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারি ছিলেন উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা (রা.)।
সম্মানিত পাঠক! আসুন কুরআন ও হাদিসের আলোকে জেনে নেই আম্মাজানের শান মান মর্যাদা-
১. রাসূলে পাক (সা.) এর স্বপ্ন:
আম্মাজান আয়েশা (রা.) রাসূল (সা.) এর সহধর্মিনী হবেন তা মহান আল্লাহ হুযুর কে আগেই স্বপ্ন মারফত দেখিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলেন। বর্ণিত-
عَنْ عَائِشَةَ، أَنَّهَا قَالَتْ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم
أُرِيتُكِ فِي الْمَنَامِ ثَلاَثَ لَيَالٍ جَاءَنِي بِكِ الْمَلَكُ فِي سَرَقَةٍ مِنْ حَرِيرٍ فَيَقُولُ هَذِهِ امْرَأَتُكَ . فَأَكْشِفُ عَنْ وَجْهِكِ فَإِذَا أَنْتِ هِيَ فَأَقُولُ إِنْ يَكُ هَذَا مِنْ عِنْدِ اللَّهِ يُمْضِهِ
মা আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, স্বপ্নের মাধ্যমে তিনদিন তোমায় আমাকে দেখানো হয়েছে। একজন ফেরেশতা তোমাকে একটি রেশমী কাপড়ের টুকরায় ঢেকে নিয়ে এসে বলল, এটা আপনার সহধর্মিণী। আমি তোমার মুখের বস্ত্র সরিয়ে দেখি সেটি তুমিই। আমি বললাম, যদি এ স্বপ্ন আল্লাহর তরফ হতে হয় তবে তা বাস্তবে প্রকাশিত হবে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৬১৭৭)
২. হুযুরের আখেরাতের স্ত্রী:
আম্মাজান শুধু ইহকালে নয় পরকালেও হুযুরে পাকের স্ত্রীর মর্যাদায় ভূষিত হবেন মর্মে স্বয়ং রাসূলে পাক হাদিস বর্ণনা করেছেন-
عَنْ عَائِشَةَ، أَنَّ جِبْرِيلَ، جَاءَ بِصُورَتِهَا فِي خِرْقَةِ حَرِيرٍ خَضْرَاءَ إِلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ إِنَّ هَذِهِ زَوْجَتُكَ فِي الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ -
মা আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, জিবরাঈল (আ.) একখানা সবুজ রংয়ের রেশমী কাপড়ে তার (আয়েশা) প্রতিচ্ছবি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে নিয়ে এসে বলেন, ইনি দুনিয়া ও আখিরাতে আপনার স্ত্রী।
(জামে’ আত-তিরমিজি, হাদিস নং ৩৮৮০)
অপর বর্ণনায় এসেছে-
عَنْ الْحَكَمِ سَمِعْتُ أَبَا وَائِلٍ قَالَ لَمَّا بَعَثَ عَلِيٌّ عَمَّارًا وَالْحَسَنَ إِلَى الْكُوفَةِ لِيَسْتَنْفِرَهُمْ خَطَبَ عَمَّارٌ فَقَالَ إِنِّيْ لَاعْلَمُ أَنَّهَا زَوْجَتُهُ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَلَكِنَّ اللهَ ابْتَلَاكُمْ لِتَتَّبِعُوْهُ أَوْ إِيَّاهَا-
আবূ ওয়াইল (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘আলী (রা.) তাঁর স্বপক্ষে জিহাদে সাহায্য করার জন্য লোক সংগ্রহের জন্য আম্মার ও হাসান (রা.)-কে কুফায় পাঠান। আম্মার (রা.) তাঁর ভাষণে একদা বললেন, এ কথা আমি ভালভাবেই জানি যে, আয়িশা (রা.) আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দুনিয়া ও আখিরাতের সম্মানিতা স্ত্রী। কিন্তু এখন আল্লাহ্ তোমাদেরকে পরীক্ষা করছেন যে তোমরা কি আলী (রা.)-এর আনুগত্য করবে, না আয়িশা (রাঃ)-এর আনুগত্য করবে? (সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৩৭৭২)
৩. জিবরাঈল আমিনের সালাম:
আম্মাজান আয়েশা (রা.) এর বিশেষত্বের জন্যে স্বয়ং রুহুল আমীন হযরত জিবরাঈল (আ.) তাকে সালাম জানিয়েছেন। বর্ণিত আছে-
إِنَّ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَوْمًا يَا عَائِشَ هَذَا جِبْرِيْلُ يُقْرِئُكِ السَّلَامَ فَقُلْتُ وَعَلَيْهِ السَّلَامُ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكَاتُهُ تَرَى مَا لَا أَرَى تُرِيْدُ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم-
মা আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হে আয়িশা! জিবরাঈল তোমাকে সালাম বলেছেন। আমি উত্তরে বললাম, “ওয়া আলাইহিস্ সালাম ওয়ারহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু”। আপনি যা দেখতে পান আমি তা দেখতে পাই না। এ কথা দ্বারা তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে বুঝিয়েছেন। (সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৩৭৬৮)
৪. নবীজির শয্যা সঙ্গীনি অবস্থায় অহী অবতরণ:
মা আয়েশা (রা.) এর অন্যতম বৈশিষ্ট হল, তিনি হুযুরের সঙ্গে এক কম্বলের নিচে শায়িত অবস্থায় জিবরাঈল আমীন অহী নিয়ে হুযুরের খেদমতে উপস্থিত হতেন। যা অন্যান্য উম্মুল মু’মিনীনদের বেলায় দেখা যায় নি। ইরশাদ হচ্ছে-
حَدَّثَنَا حَمَّادٌ حَدَّثَنَا هِشَامٌ عَنْ أَبِيْهِ قَالَ كَانَ النَّاسُ يَتَحَرَّوْنَ بِهَدَايَاهُمْ يَوْمَ عَائِشَةَ قَالَتْ عَائِشَةُ فَاجْتَمَعَ صَوَاحِبِيْ إِلَى أُمِّ سَلَمَةَ فَقُلْنَ يَا أُمَّ سَلَمَةَ وَاللهِ إِنَّ النَّاسَ يَتَحَرَّوْنَ بِهَدَايَاهُمْ يَوْمَ عَائِشَةَ وَإِنَّا نُرِيْدُ الْخَيْرَ كَمَا تُرِيْدُهُ عَائِشَةُ فَمُرِيْ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَنْ يَأْمُرَ النَّاسَ أَنْ يُهْدُوْا إِلَيْهِ حَيْثُ مَا كَانَ أَوْ حَيْثُ مَا دَارَ قَالَتْ فَذَكَرَتْ ذَلِكَ أُمُّ سَلَمَةَ لِلنَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَتْ فَأَعْرَضَ عَنِّيْ فَلَمَّا عَادَ إِلَيَّ ذَكَرْتُ لَهُ ذَاكَ فَأَعْرَضَ عَنِّيْ فَلَمَّا كَانَ فِي الثَّالِثَةِ ذَكَرْتُ لَهُ فَقَالَ يَا أُمَّ سَلَمَةَ لَا تُؤْذِيْنِيْ فِيْ عَائِشَةَ فَإِنَّهُ وَاللهِ مَا نَزَلَ عَلَيَّ الْوَحْيُ وَأَنَا فِيْ لِحَافِ امْرَأَةٍ مِنْكُنَّ غَيْرِهَا-
হাম্মাদ (রহ.) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, লোকেরা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে হাদীয়া প্রদানের জন্য আয়েশা (রা.)-এর গৃহে তাঁর অবস্থানের দিন হিসাব করতেন। আয়িশা (রা.) বলেন, একদা আমার সতীনগণ উম্মু সালামাহ (রা.)-এর নিকট সমবেত হয়ে বললেন, হে উম্মু সালামাহ! আল্লাহ্র কসম, লোকজন তাদের উপঢৌকনসমূহ প্রেরণের জন্য আয়েশা (রা.)-এর গৃহে অবস্থানের দিন গণনা করেন। আয়েশা (রা.)-এর মত আমরাও কল্যাণ আকাঙ্ক্ষা করি। আপনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে বলুন, তিনি যেন লোকদের বলে দেন, তারা যেন আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেদিন যেখানে অবস্থান করেন সেখানে তারা হাদীয়া পাঠিয়ে দেন। উম্মু সালামাহ (রা.) বলেন, তিনি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সঙ্গে এ বিষয়ে উল্লেখ করলেন। উম্মু সালামাহ (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার কথা শুনে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। পরে আমার গৃহে অবস্থানের জন্য পুনরায় আসলে আমি ঐ কথা তাঁকে বলি। এবারও তিনি মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তৃতীয়বারেও আমি ঐ কথা তাঁকে বললাম, তিনি বললেন, হে উম্মু সালামা! আয়েশা (রা.)-এর ব্যাপারে তোমরা আমাকে কষ্ট দিও না। আল্লাহ্র কসম, তোমাদের মধ্যে আয়েশা (রা.) ছাড়া অন্য কারো শয্যায় শায়িত থাকা কালীন আমার উপর অহী নাযিল হয়নি। (সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৩৭৭৫)
৫. আয়েশা (রা.) প্রতি হুযুরের ভালোবাসা:
আম্মাজানের প্রতি রহমতে আ’লম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভালোবাসার কিছু নমুনা।
حَدَّثَنِيْ عَمْرُوْ بْنُ الْعَاصِ أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم بَعَثَهُ عَلَى جَيْشِ ذَاتِ السُّلَاسِلِ فَأَتَيْتُهُ فَقُلْتُ أَيُّ النَّاسِ أَحَبُّ إِلَيْكَ قَالَ عَائِشَةُ فَقُلْتُ مِنْ الرِّجَالِ فَقَالَ أَبُوْهَا قُلْتُ ثُمَّ مَنْ قَالَ ثُمَّ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ فَعَدَّ رِجَالًا-
আমর ইবনু আ’স (রাঃ) থেকে বর্ণিত,
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে যাতুস সালাসিল যুদ্ধের সেনাপতি করে পাঠিয়ে ছিলেন। তিনি বলেন, আমি তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, মানুষের মধ্যে কে আপনার নিকট সবচেয়ে প্রিয়? তিনি বললেন, আয়েশা! আমি বললাম, পুরুষদের মধ্যে কে? তিনি বললেন, তাঁর পিতা (আবূ বকর রা.)। আমি জিজ্ঞেস করলাম, অতঃপর কোন লোকটি? তিনি বললেন, উমার ইব্নু খাত্তাব রা. অতঃপর আরো কয়েকজনের নাম উল্লেখ করলেন। (সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৩৬৬২)
পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার আগেও আম্মাজানের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করেছেন।
عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ إِنْ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لَيَتَعَذَّرُ فِي مَرَضِهِ “ أَيْنَ أَنَا الْيَوْمَ أَيْنَ أَنَا غَدًا
اسْتِبْطَاءً لِيَوْمِ عَائِشَةَ، فَلَمَّا كَانَ يَوْمِي قَبَضَهُ اللَّهُ بَيْنَ سَحْرِي وَنَحْرِي، وَدُفِنَ فِي بَيْتِي-
মা আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রোগশয্যায় (স্ত্রীগণের নিকট অবস্থানের) পালার সময়কাল জানতে চাইতেন। আমার অবস্থান আজ কোথায় হবে? আগামীকাল কোথায় হবে? আয়েশা (রা.)-এর পালা বিলম্বিত হচ্ছে বলে ধারণা করেই এ প্রশ্ন করতেন। আয়েশা (রা.) বলেন- যে দিন আমার পালা আসলো, সেদিন আল্লাহ তাঁকে আমার কন্ঠদেশ ও বক্ষের মাঝে হেলান দেয়া অবস্থায় রূহ ক্ববয করলেন এবং আমার ঘরে তাঁকে দাফন করা হয়। (সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৩৭৭৪)
অপর বর্ণনায় এসেছে-
عَنْ أَبِي مُوسَى ـ رضى الله عنه ـ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم “ كَمَلَ مِنَ الرِّجَالِ كَثِيرٌ، وَلَمْ يَكْمُلْ مِنَ النِّسَاءِ إِلاَّ آسِيَةُ امْرَأَةُ فِرْعَوْنَ، وَمَرْيَمُ بِنْتُ عِمْرَانَ، وَإِنَّ فَضْلَ عَائِشَةَ عَلَى النِّسَاءِ كَفَضْلِ الثَّرِيدِ عَلَى سَائِرِ الطَّعَامِ -
আবূ মূসা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, পুরুষদের মধ্যে অনেকেই পূর্ণতা অর্জন করেছেন। কিন্তু মহিলাদের মধ্যে ফির‘আউনের স্ত্রী আসিয়া এবং ইমরানের কন্যা মারইয়াম ব্যতীত আর কেউ পূর্ণতা অর্জনে সক্ষম হয়নি। তবে আয়েশার মর্যাদা সব মহিলার উপর এমন, যেমন সারীদের (গোশতের ঝোলে ভিজা রুটির) মর্যাদা সকল প্রকার খাদ্যের উপর। (সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৩৪১১)
৬. মা আয়েশাকে মুহাব্বাত যেন রাসুলকে মুহাব্বাত:
আম্মাজান কে মুহাব্বত করা মানে নবীজি কে মুহাব্বত করা কেননা হুযুর (সা.) তাঁকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন। এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে-
أَنَّ عَائِشَةَ، زَوْجَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَتْ أَرْسَلَ أَزْوَاجُ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَاطِمَةَ بِنْتَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَاسْتَأْذَنَتْ عَلَيْهِ وَهُوَ مُضْطَجِعٌ مَعِي فِي مِرْطِي فَأَذِنَ لَهَا فَقَالَتْ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ أَزْوَاجَكَ أَرْسَلْنَنِي إِلَيْكَ يَسْأَلْنَكَ الْعَدْلَ فِي ابْنَةِ أَبِي قُحَافَةَ وَأَنَا سَاكِتَةٌ – قَالَتْ – فَقَالَ لَهَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ” أَىْ بُنَيَّةُ
أَلَسْتِ تُحِبِّينَ مَا أُحِبُّ ؟فَقَالَتْ بَلَى . قَالَ ” فَأَحِبِّي هَذِهِ ”-
আম্মাজান আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী সহধর্মিণীগণ রসূল কন্যা ফাতিমাকে তাঁর নিকট প্রেরণ করলেন। সে এসে অনুমতি প্রার্থনা করল। তখন তিনি আমার চাদর গায়ে আমার সাথে ঘুমিয়ে ছিলেন। তিনি তাঁকে অনুমতি প্রদান করলেন। ফাতিমা (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার স্ত্রীগণ আমাকে পাঠিয়েছেন, আবূ কুহাফার কন্যার সম্বন্ধে তাঁরা আপনার ন্যায়-বিচার চান। আমি চুপ করে রইলাম। রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে বললেন, হে আদরের কন্যা! আমি যা ভালবাসি, তা-কি তুমি ভালবাসো না? সে বললেন, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তবে একে ভালবাসো।
(সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৬১৮৪)
৭. হুযুরের একমাত্র কুমারী স্ত্রী:
তিনিই একমাত্র নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কুমারী বিবি। বর্ণিত আছে-
عَنْ عَائِشَةَ ـ رضى الله عنها ـ قَالَتْ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَرَأَيْتَ لَوْ نَزَلْتَ وَادِيًا وَفِيهِ شَجَرَةٌ قَدْ أُكِلَ مِنْهَا، وَوَجَدْتَ شَجَرًا لَمْ يُؤْكَلْ مِنْهَا، فِي أَيِّهَا كُنْتَ تُرْتِعُ بَعِيرَكَ قَالَ “ فِي الَّذِي لَمْ يُرْتَعْ مِنْهَا ”
تَعْنِي أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لَمْ يَتَزَوَّجْ بِكْرًا غَيْرَهَا
উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন যে,আমি বললাম, হে আল্লাহ্র রাসূল! মনে করুন আপনি একটি ময়দানে পৌঁছেছেন, সেখানে একটি গাছ আছে যার কিছু অংশ খাওয়া হয়ে গেছে। আর এমন একটি গাছ পেলেন, যার কিছুই খাওয়া হয়নি। এর মধ্যে কোন্ গাছের পাতা আপনার উটকে খাওয়াবেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তরে বললেন, যে গাছ থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি। এ কথার উদ্দেশ্য হল – নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে ব্যতীত অন্য কোন কুমারীকে বিয়ে করেননি। (সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৫০৭৭)
৮. তাঁর কারনে তায়াম্মুমের বিধান:
মা আয়েশা (রা.) কে উপলক্ষ্য বানিয়ে মহান আল্লাহ এ উম্মতের জন্য তায়াম্মুমের(পানির অবর্তমানে) বিধান দিয়েছেন। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে-
عَنْ عَائِشَةَ، أَنَّهَا اسْتَعَارَتْ مِنْ أَسْمَاءَ قِلاَدَةً فَهَلَكَتْ، فَبَعَثَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم رَجُلاً، فَوَجَدَهَا فَأَدْرَكَتْهُمُ الصَّلاَةُ وَلَيْسَ مَعَهُمْ مَاءٌ فَصَلَّوْا، فَشَكَوْا ذَلِكَ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَأَنْزَلَ اللَّهُ آيَةَ التَّيَمُّمِ. فَقَالَ أُسَيْدُ بْنُ حُضَيْرٍ لِعَائِشَةَ جَزَاكِ اللَّهُ خَيْرًا، فَوَاللَّهِ مَا نَزَلَ بِكِ أَمْرٌ تَكْرَهِينَهُ إِلاَّ جَعَلَ اللَّهُ ذَلِكِ لَكِ وَلِلْمُسْلِمِينَ فِيهِ خَيْرًا.
হযরত মা আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি একদা (তাঁর বোন) আসমা (রা.) এর হার ধার করে নিয়ে গিয়েছিলেন। (পথিমধ্যে) হারখানা হারিয়ে গেল। আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-সেটির অনুসন্ধানে লোক পাঠালেন। তিনি হারটি এমন সময় পেলেন, যখন তাঁদের সালাতের সময় হয়ে গিয়েছিল অথচ তাঁদের কাছে পানি ছিল না। তাঁরা সালাত আদায় করলেন। তারপর বিষয়টি তাঁরা আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট বর্ণনা করেন। তখন আল্লাহ্ তা’আলা তায়াম্মুমের আয়াত অবতীর্ণ করেন। সেজন্য উসায়দ ইব্নু হুযায়র (রা.) আয়েশা (রা.) কে লক্ষ্য করে বললেনঃ আল্লাহ্ আপনাকে উত্তম প্রতিদান প্রদান করুন। আল্লাহ্র কসম! আপনি যে কোন অপছন্দনীয় অবস্থার মুখোমুখী হয়েছেন, তাতেই আল্লাহ্ তা’আলা আপনার ও সমস্ত মুসলমানের জন্য মঙ্গল রেখেছেন। (সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৩৩৬)
৯. তাঁর কোলে হুযুরের ইন্তেকাল:
আম্মাজান আয়েশা (রা.) এর হুজরাখানায় তাঁর কোলে মাথা রেখে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাত এবং সেই ঘরই হুযুরের রওযা মোবারক।
أَنَّ عَائِشَةَ كَانَتْ تَقُوْلُ إِنَّ مِنْ نِعَمِ اللهِ عَلَيَّ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم تُوُفِّيَ فِيْ بَيْتِيْ وَفِيْ يَوْمِيْ وَبَيْنَ سَحْرِيْ وَنَحْرِيْ وَأَنَّ اللهَ جَمَعَ بَيْنَ رِيْقِيْ وَرِيْقِهِ عِنْدَ مَوْتِهِ دَخَلَ عَلَيَّ عَبْدُ الرَّحْمَنِ وَبِيَدِهِ السِّوَاكُ وَأَنَا مُسْنِدَةٌ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَرَأَيْتُهُ يَنْظُرُ إِلَيْهِ وَعَرَفْتُ أَنَّهُ يُحِبُّ السِّوَاكَ فَقُلْتُ آخُذُهُ لَكَ فَأَشَارَ بِرَأْسِهِ أَنْ نَعَمْ فَتَنَاوَلْتُهُ فَاشْتَدَّ عَلَيْهِ وَقُلْتُ أُلَيِّنُهُ لَكَ فَأَشَارَ بِرَأْسِهِ أَنْ نَعَمْ فَلَيَّنْتُهُ فَأَمَرَّهُ وَبَيْنَ يَدَيْهِ رَكْوَةٌ أَوْ عُلْبَةٌ يَشُكُّ عُمَرُ فِيْهَا مَاءٌ فَجَعَلَ يُدْخِلُ يَدَيْهِ فِي الْمَاءِ فَيَمْسَحُ بِهِمَا وَجْهَهُ يَقُوْلُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ إِنَّ لِلْمَوْتِ سَكَرَاتٍ ثُمَّ نَصَبَ يَدَهُ فَجَعَلَ يَقُوْلُ فِي الرَّفِيْقِ الْأَعْلَى حَتَّى قُبِضَ وَمَالَتْ يَدُهُ-
মা আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি প্রায়ই বলতেন, আমার প্রতি আল্লাহর এটা নি’য়ামাত যে, আমার ঘরে আমার পালার দিনে এবং আমার গণ্ড ও সীনার মাঝে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ইন্তিকাল হয় এবং আল্লাহ তা’আলা তাঁর ইন্তিকালের সময় আমার থুথু তাঁর থুথুর সঙ্গে মিশ্রিত করে দেন। এ সময় আবদুর রহমান (রা.) আমার নিকট প্রবেশ করে এবং তার হাতে মিসওয়াক ছিল। আর আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে (আমার বুকে) হেলান অবস্থায় রেখেছিলাম। আমি লক্ষ্য করলাম যে, তিনি আবদুর রহমানের দিকে তাকাচ্ছেন। আমি বুঝলাম যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিসওয়াক চাচ্ছেন। আমি তখন জিজ্ঞেস করলাম, আমি কি আপনার জন্য মিসওয়াক নিব? তিনি মাথা নাড়িয়ে জানালেন যে, হ্যাঁ। তখন আমি মিসওয়াকটি নিলাম। কিন্তু মিসওয়াক ছিল তার জন্য শক্ত, তাই আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমি কি এটি আপনার জন্য নরম করে দিব? তখন তিনি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললেন। তখন আমি তা চিবিয়ে নরম করে দিলাম। এরপর তিনি ভালভাবে মিসওয়াক করলেন। তাঁর সম্মুখে পাত্র অথবা পেয়ালা ছিল (রাবী উমারের সন্দেহ) তাতে পানি ছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় হস্তদ্বয় পানির মধ্যে প্রবেশ করিয়ে তার দ্বারা তাঁর চেহারা মুছতে লাগলেন। তিনি বলছিলেন- আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ নেই, সত্যিই মৃত্যু-যন্ত্রণা কঠিন। তারপর দু’হাত উপরের দিকে উঠিয়ে বলছিলেন, আমি উচ্চে সমাসীন বন্ধুর সঙ্গে (মিলিত হতে চাই)। এ অবস্থায় তাঁর ইন্তিকাল হল আর হাত মোবারক শিথিল হয়ে গেল। (সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৪৪৪৯)
১০. মা আয়েশার (রা:) চারিত্রিক পবিত্রতা:
আম্মাজান আয়েশা (রা.) কে পবিত্র বলে মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহর পাকের ঘোষণা-
اَلۡخَبِیۡثٰتُ لِلۡخَبِیۡثِیۡنَ وَ الۡخَبِیۡثُوۡنَ لِلۡخَبِیۡثٰتِ ۚ وَ الطَّیِّبٰتُ لِلطَّیِّبِیۡنَ وَ الطَّیِّبُوۡنَ لِلطَّیِّبٰتِ ۚ اُولٰٓئِکَ مُبَرَّءُوۡنَ مِمَّا یَقُوۡلُوۡنَ ؕ لَہُمۡ مَّغۡفِرَۃٌ وَّ رِزۡقٌ کَرِیۡمٌ-
অর্থ- দুশ্চরিত্রা নারীরা দুশ্চরিত্র পুরুষদের জন্য এবং দুশ্চরিত্র পুরুষরা দুশ্চরিত্রা নারীদের জন্য। আর সচ্চরিত্রা নারীরা সচ্চরিত্র পুরুষদের জন্য এবং সচ্চরিত্র পুরুষরা সচ্চরিত্রা নারীদের জন্য; লোকেরা যা বলে, তারা তা থেকে মুক্ত। তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও সম্মানজনক রিয্ক। (সুরা নুর-২৬); বুখারীর ২৬৬১ নং হাদীসে এ প্রসঙ্গে লম্বা আলোচনা রয়েছে, প্রয়োজনে দেখে নিতে পারেন।
আম্মাজানের পবিত্র হওয়ার ব্যাপারে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘোষণা-
يا معشر المسلمين، مَن يَعذِرُني من رجلٍ قد بلغَني أذاه في أهل بيتي؟ فوالله، ما علمتُ على أهلي إلا خيرًا-
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমার পরিবারকে কেন্দ্র করে যে ব্যক্তি আমাকে জ্বালাতন করেছে, তার মুকাবিলায় কে প্রতিকার করবে? আল্লাহর কসম, আমি তো আমার স্ত্রী সম্পর্কে ভালো ব্যতীত অন্য কিছু জানি না। (বুখারী-২৬৬১)
পরিশিষ্ট:
হযরত মা আয়েশা (রা.) বয়সে ছোট হওয়ার কারণে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার শৈশবকে খুব গুরুত্ব দিতেন, হাদিসে এসেছে-
عَنْ عَائِشَةَ، أَنَّهَا كَانَتْ تَلْعَبُ بِالْبَنَاتِ عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَتْ وَكَانَتْ تَأْتِينِي صَوَاحِبِي فَكُنَّ يَنْقَمِعْنَ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَتْ فَكَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يُسَرِّبُهُنَّ إِلَىَّ
মা আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিতঃ তিনি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট পুতুল নিয়ে খেলা করতেন। তিনি বলেন, তখন আমার নিকট আমার সঙ্গীরা আসতো। তারা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে দেখে আড়ালে যেতো। আর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে আমার নিকট পাঠিয়ে দিতেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৬১৮১)
উম্মুল মু’মিনীন মা আয়েশা (রা.) জ্ঞান গরীমায় ছিলেন অনন্য তিনি ছিলেন সেরাদের সেরা। সাতজন শ্রেষ্ঠ ফকিহদের একজন আম্মাজান আয়েশা (রা.)।
قال ابن القيِّم رحمه الله
والذين حُفِظت عنهم الفتوى من الصحابة مائة ونيِّف وثلاثون نفسًا ما بين رجل وامرأة، وكان المكثرون منهم سبعةً: عمر بن الخطاب، وعلي بن أبي طالب، وعبد الله بن مسعود، وعائشة أم المؤمنين، وزيد بن ثابت، وعبد الله بن عباس، وعبد الله بن عمر…
ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, যেই সাহাবাদের কাছ থেকে ফাতওয়া সংরক্ষণ করা হয়েছে তাদের সংখা প্রায় একশত ত্রিশের অধিক (১৩০) সাহাবা, সাহাবীয়া , তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন সাতজন, ওমর ইবনুল খাত্তাব,
আলি ইবনে আবি তালিব, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, উম্মুল মুমিনিন আয়েশা, যায়েদ বিন সাবিত, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুম আজমাইন।
(إعلام الموقعين-١/٦٣)
সীহাহ সিত্তাতে বেশি পরিমাণ হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে আম্মাজান আয়েশা (রা.) এর অবস্থান দ্বিতীয়
ومجموع مرويات عائشة رضي الله عنها في الكتب الستة ألفين وواحد وثمانين حديثًا-
ছয় কিতাবে আম্মাজানের বর্ণিত হাদীসের সংখা দুই হাজার একাশি।
إن مجموع أحاديثها في الصحيحين مائتا حديث وتسعة وتسعون حديثًا-
শুধুমাত্র বুখারী ও মুসলিমে আম্মাজানের বর্নীত হাদীসের সংখ্যা দুইশত নিরানব্বই খানা।
سير أعلام النبلاء-٢/١٣٥
আম্মাজানের থেকে হাদীস বর্ণনা কারীর সংখ্যা প্রায় তিনশত পঞ্চাশ। তন্মধ্যে অন্যতম হলেন হযরত আবু বকর, ওমর, ইবনে ওমর, হাসান ইবনে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুমদের মতো সাহাবাগণ।
وقال سفيان الثوري
عِلمها أكثر من علم أيٍّ من زوجات النبي صلى الله عليه وسلم
ইমাম সুফিয়ান সাওরী (রহ.) বলেন, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার ইলম্ নবিজীর সব বিবিদের চেয়ে বেশি ছিল।
পরিশেষে আল্লাহ পাক তাঁর শান মান মর্যাদাকে আরো বুলন্দি দান করুন। মূর্খ অজ্ঞ বেওকুফদেরকে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে অবগত হবার তাওফিক্ব দান করুন। আমীন।
লেখক– আরবি প্রভাষক, জকিগঞ্জ ফাযিল সিনিয়র মাদরাসা।
মানবতার বন্ধু হযরত মুহাম্মদ (সা.)
-মহসিন আহমদ
“মানুষে মানুষে অধিকার দিল যে-জন
এক আল্লাহ ছাড়া প্রভু নাহি কহিল যে-জন
মানুষের লাগি চির দীন-হীন বেশ ধরিল যে-জন
বাদশা-ফকিরে এক শামিল করিল যে-জন
এলো ধরায় ধরা দিতে সেই সে নবী
ব্যথিত মানবের ধ্যানের ছবি
(আমাদের প্রিয়নবী মহানবী সা.)”
– কাজী নজরুল ইসলাম
সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন মানবকুলসহ সমগ্র সৃষ্টিজগতের জন্য রহমতস্বরূপ। বিশ্বমানবতার তিনি যে পরম বন্ধু ও ত্রানকর্তা ছিলেন- তা সর্বজন ও সর্বমহল কর্তৃক স্বীকৃত। আইয়্যামে জাহেলিয়া তথা অন্ধকার যুগে তাঁর আগমনে অব্যাহতি পেয়েছিল নির্যাতিত-নিষ্পেষিত ও উৎপীড়িত অসহায় মানবসমাজ। তিনি তৎকালীন বর্বরতার যুগের অজ্ঞতা-অন্ধকার ও অন্যায়-অরাজকতাপূর্ণ সমাজকে সোনালী সমাজে পরিণত করেছিলেন, মানুষকে মানুষ পরিচয়ে পরিচিত করে করেছিলেন সম্মানিত। তিনি স্থাপন করেছিলেন মানবতার কল্যাণে পূর্ণাঙ্গ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সার্বজনীন দৃষ্টান্ত, ‘বিদায় হজ্জের ভাষণ’ যার উজ্জ্বল উপমা ও শ্রেষ্ঠ দলিল ।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) যে মানবতার বন্ধু ছিলেন, সে সম্পর্কে যৎসামান্য উল্লেখ করার পূর্বে প্রথমেই ‘মানবতা’ কিংবা ‘মানবতার বন্ধু‘ বলতে কী বুঝায়- তা স্পষ্ট করা দরকার।
মানবতা :
মানবতা শব্দের অর্থ ও তাৎপর্যের ব্যাপক ব্যাপ্তি থাকলেও সাধারণ দৃষ্টিতে মানবতা হলো মানুষের এমন একটি বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম, যার দ্বারা একজন মানুষ পূর্ণাঙ্গ মানুষে পরিণত হয়। আরো সহজ কথায়, মানবতা হলো মানুষের জন্য মানুষের ভালোবাসা, স্নেহ-মায়ামমতা, মানুষের ক্ষতি না করে কল্যাণকামী হওয়া। আর মানবতার বন্ধু? যিনি মানুষকে ভালোবাসেন, আত্মস্বার্থ ত্যাগ করে মানুষের উপকার করেন, মানুষের কষ্ট বা ক্ষতি হয় এমন কাজ থেকে বিরত থেকে তাদের দুঃখ-কষ্ট দূরীকরণে চেষ্টা করেন, সর্বোপরি সকল মানুষকে মানুষ হিসেবে সমান মর্যাদায় সমভাবে বিবেচনা করেন এবং মানুষের মানবিক অধিকার পূরণে চেষ্টা করেন, তিনিই হচ্ছেন মানবতার বন্ধু।
মানবতার বন্ধু হিসেবে মুহাম্মদ (সা.):
সর্বকালের সেরা মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সা.) মানবতার সর্বোত্তম বন্ধু ছিলেন, ছিলেন দিকনির্দেশক ও আদর্শ-অভিভাবক। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সার্বজনীন মানবাধিকারের যে ঘোষণাপত্র ঘোষণা করে, ১৪০০ বছর আগেই রাসূল (সা.) ‘বিদায় হজ্জের ভাষণে’ সে ঘোষণাপত্রের প্রধান ও মৌলিক সবগুলিই ঘোষণা করেছিলেন এবং সে সমাজের সর্বস্তরে তা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করে করেছিলেন বিশ্বে বিস্ময় সৃষ্টি। (বলা হয়ে থাকে, মানুষের কল্যাণে) মানবতার শ্রেষ্ঠত্ব পরিমাপের যত মাপকাঠি আছে, সবগুলির ভিত্তিতেই রাসূল (সা.) ছিলেন সকলের ঊর্ধ্বে, সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ। এটা কেবল মুসলমান মনীষীগনেরই বক্তব্য নয়, বরং বিবেকবান অমুসলিম মনীষীগণও তা স্বীকার করেছেন এবং স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। যেমন প্রাশ্চাত্য প্রন্ডিত ল্যামার্টিন বলেন, ‘মানুষের শ্রেষ্টত্ব পরিমাপের যত মানদন্ড আছে, তার ভিত্তিতে বিবেচনা করলে আমরা নিজেদেরকে বলতে পারি- মুহাম্মদের চেয়ে শ্রেষ্ট ও সর্বোত্তম কেউ আছে কি?’
রাসূলে আরবি (সা.) এর সমগ্রজীবনের প্রতিটি পরতে পরতে রয়েছে মানবজীবন শান্তি-সুখময় করার এবং পূর্ণমানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সার্বজনীন আদর্শ ও দৃষ্টান্ত। নিম্নে মানবতার বন্ধুরূপে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর সিন্ধুস্বরূপ কার্যক্রমের বিন্দুসদৃশ কতিপয় দৃষ্টান্ত উপাস্থাপনের নগণ্য ও অতিক্ষুদ্র প্রচেষ্টা করা হলো-
বিশ্বমানবতার পথপ্রদর্শকস্বরূপ আবির্ভাব :
তৎকালীন আরব সমাজ ছিল ঘোর তমসা-তিমিরে নিমজ্জিত, সর্বত্রই বিরাজ করছিল অশান্তি-অনাচার আর অরাজকতা। মানবাধিকার বলতে সে সমাজে কোনোকিছু ছিল না; পাপ-পঙ্কিলতা, অনাচার-অবিচার ও বর্বতার জন্য সে যুগকে বলা হতো ‘আইয়্যামে জাহেলিয়া’ তথা অজ্ঞতার যুগ। সেই অজ্ঞতার যুগের অন্ধকারাচ্ছন্নতাকে দূরীভূত করতে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ১২-ই রবিউল আউয়াল, সোমবার সুবহে সাদিকের প্রাতঃকালে পৃথিবীতে আলোকবর্তিকারূপে আগমন করেছিলেন বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত ও পথপ্রদর্শক মহানবী (সা.)। তাঁর আগমনে ধূলির ধরায় বয়েছিল আনন্দের হিল্লোল, বর্ষিত হয়েছিল শান্তি-সুখের বিরামহীন বারিধারা। কবির ভাষায়,
‘কুল মাখলুক খুশিতে আজ
পায় না রে দিশা
এসেছেন দ্বীনের নবী
ঘুচিবে প্রাণের তৃষা’
তাছাড়া, কেবল বিশেষ কোনো কওম বা জাতির জন্যই আবির্ভাব হয় নি তাঁর, বরং সমগ্রবিশ্বের সকল মানবের মুক্তির দিশারী হিসেবে আগমন করেছিলেন তিনি। আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আপনাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রেরণ করেছি।’ (সাবা: ২৮)
একত্ববাদের প্রতি আহ্বান :
“দেখ্ আমিনা মায়ের কোলে
দোলে শিশু ইসলাম দোলে
কচি মুখে শাহাদাতের
বাণী সে শুনায়!”
মানবতার মর্যাদা বিকাশের সর্বোচ্চ ও সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় হলো সৃষ্টিকর্তার একত্ববাদ ও তাওহিদে বিশ্বাস। অপরদিকে, মানবতার পতন, লাঞ্ছনা-বঞ্চনা ও অপমান-অপদস্থের সর্বনিকৃষ্ট পথ হলো শিরক করা। রাসূল (সা.) এর সমগ্রজীবনের মূল মিশন এবং ভিশন ছিল সৃষ্টির সেরা জীব মানুষকে সে শিরক থেকে মুক্ত করে সারাজাহানের স্রষ্টার সামনে মাথানত করতে শিখানো এবং পৃথিবীর সকল সৃষ্টি থেকে মানুষকে অমুখাপেক্ষী করে মর্যাদাবান করা। এ মর্মে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাঁর সাথে কোনোকিছু শরীক করো না।’ (নিসা: ৩৫)
মানবতার মর্যাদা বিকাশে রাসূল (সা.) :
মহানবী (সা.) ধর্ম-বর্ণ ও ভাষার ঊর্ধ্বে উঠে মানব ও মানবতার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় এক অনুপম ও বিস্ময়কর দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্ববাসীকে উপহার দিয়েছিলেন। মানুষকে শুধু মানুষ হিসেবে তার মর্যাদা ও সম্মানের ঘোষণা শুনিয়েছিলেন এই পৃথিবীকে। ঘোষণা করেছিলেন, ‘মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা জীব’। কুরআনের ভাষায়, ‘আমিতো আদম সন্তানকে সম্মান ও মর্যাদা দান করেছি, স্থলে ও সমুদ্রে বাহন দিয়েছি এবং দিয়েছি উত্তম রিজিক।’ (বনী ঈসরাইল: ৭০)
মানুষের দুঃখ-কষ্ট দূরীকরণ ও প্রয়োজন পূরণে :
মানুষের দুঃখ-কষ্ট দূরীকরণ ও প্রয়োজন পূরণে মহানবী (সা.) ছিলেন বিশ্বমানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ-উদাহরণ। গোটা জীবনব্যাপী তিনি মানুষের দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-আপদ ও প্রয়োজন পূরণে নিজে এগিয়ে এসেছিলেন এবং অন্যকেও এগিয়ে আসতে দিয়েছিলেন তাগিদ। ঘোষণা করেছিলেন মানবতাবোধের অমীয় বাণী, ‘যে তার অপর ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করবে, আল্লাহ তার প্রয়োজন পূরণ করবেন; একইভাবে যে তার অপর ভাইয়ের দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-আপদ দূর করবে, আল্লাহ কেয়ামতের দিন তার বিপদ দূর করবেন।’ (বুখারী-মুসলিম)
তাছাড়া, তিনি মানুষের শুভাকাঙ্ক্ষী-হিতৈষীকে সর্বোত্তম মানব বলে আখ্যায়িত করে মানবতাবোধকে শ্রেষ্ঠ স্থানে সমাসীন করেছেন। এ মর্মে ঘোষিত হয়েছে মানবতাবোধের সুমহান বাণী, ‘সেই সর্বোত্তম মানুষ, যে অন্য মানুষের উপকার করে।’ (সুনানে দারাকুতনি)
শিশু ও বৃদ্ধদের প্রতি :
মানবজীবনের সবচেয়ে নাজুক ও অসহায় মূহুর্ত হলো শিশু এবং বৃদ্ধকাল। শিশু-বৃদ্ধদের প্রতি মহানবীর ছিল অজস্র-অন্তহীন ভালোবাসা ও মায়া-মমতা। এরই প্রেক্ষিতে তিনি ইরশাদ করেন, ‘যে ছোটদেরকে স্নেহ করে না এবং বড়দেরকে সম্মান করে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’(তীরমিযি )
অপরদিকে, রাসূল (সা.) শিশুদেরকে পিতামাতা এবং বৃদ্ধদেরকে সন্তান-সন্ততির উপর তাদের প্রতিপালন ও দেখাশুনার দায়িত্বকে বাধ্যতামূলক বলে ঘোষণা করে মানবতার মর্যাদাকে সুমন্নত করেছেন। তিনি বৃদ্ধ পিতা-মাতার কল্যাণে ও নিজেদের প্রতি তাদের অনুগ্রহের স্বীকৃতিস্বরূপ মানুষকে শিখিয়েছেন স্বর্গীয় প্রার্থনাবাণী- ‘হে আমার রব, তাদের (পিতা-মাতার) প্রতি অনুগ্রহ করুন যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে লালন-পালন করেছেন।’ (বনীইসরাইল: ২৪)
সমাজ সংস্কারে :
“আজকে যত পাপী ও তাপী
সব গুনাহের পেল মাপী
দুনিয়া হতে বে-ইনসাফী
জুলুম নিলো- বিদায়।”
তৎকালীন বর্বর যুগের আরব সমাজে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয়সহ মানবজীবনের সর্বক্ষেত্রে চলছিল অন্যায়-অবিচার ও জুলুম-নির্যাতনের স্টিম রুলার। সমাজে প্রচলিত ছিল “Might is right (জোর যার, মুল্লোক তার), Blood for blood (রক্তের বদলে রক্ত) -এর মতো মানবতা বিধ্বংসী কুখ্যাত কিছু প্রথা। মহানবী (সা.) ধূলোর ধরার এমন অমানবিকতাপূর্ণ ও অধঃপতিত এক অসভ্য-উচ্ছৃঙ্খল সমাজে জন্ম গ্রহণ করে সে সমাজকে করেছিলেন শ্রেষ্ঠ-সভ্য, সোনালি-শান্তিময় সমাজ। তিনি সমাজে যুগ যুগ ধরে চলমান জুলুম-নির্যাতন, অন্যায়-অবিচারের অপনোদনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিপীড়িত-উৎপীড়িত, নিষ্পেষিত-নির্যাতিত মানবগোষ্ঠির সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ সকলপ্রকার মানবিক মর্যাদা ও অধিকার।
আর তিনিই সমাজে শান্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মাত্র ১৭ বছর বয়সে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পৃথিবীর প্রথম মানবাধিকার সংগঠন ‘হিলফুল ফুজুল’, যা বিশ্বইতিহাসে প্রথম শান্তিসংঘ নামে পরিচিত।
অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় :
মহানবী (সা.) নারী-পুরুষ উভয়কে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা লাভের অধিকার প্রদান করে বিশ্বে বিস্ময় সৃষ্টি করেছিলেন। ঘোষণা করেছিলেন যে, ‘নারীরাও পুরুষের ন্যায় সম্পদের অধিকারী ও উত্তরাধিকারী হতে পারে’। প্রদান করেছিলেন পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরকেও বৈধপন্থায় জীবিকা উপার্জনের অধিকার। বলেছিলেন, ‘স্ত্রীর উপার্জিত সম্পদ অনুমতি ব্যতীত স্বামী ব্যবহার করতে পারবে না’। এ মর্মে কুরআন কারীমে ইরশাদ হয়েছে, ‘পুরুষ যা উপার্জন করে, তা তার প্রাপ্য; আর নারী যা উপার্জন করে, তা তার প্রাপ্য’ (৪: ৩২)।
আবার অপরদিকে, তৎকালীন সমাজে অর্থনীতিতে মদ-জুয়া, সুদ আর শোষণের ফলে মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের ফারাক ছিল আকাশ-পাতাল। ফলশ্রুতিতে, ধনী হতো আরো ধনবান, দরিদ্র হতো আরো দীন-দরিদ্র। রাসূল (সা.) এমন অর্থনৈতিক শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের মূলে কুঠারাঘাত করে এগুলোর অবসান করেন এবং ধনীদের সম্পত্তিতে দরিদ্রদের নির্ধারিত অংশ সাব্যস্ত করে প্রতিষ্ঠা করেন সকল মানুষের অর্থনৈতিক অধিকার। এজন্য তিনি যে সকল যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, সেগুলোর অন্যতম একটি হলো ‘যাকাত’ ব্যবস্থার প্রচলন।
শান্তি প্রতিষ্ঠায় :
মহানবী (সা.) বিশ্বজগতের শান্তি ও কল্যাণের শাশ্বত বার্তা বাহকরূপে এ ধূলির ধরায় আবির্ভূত হয়েছিলেন। জীবনের আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত তিনি সমগ্র বিশ্বের নৈরাজ্য ও অন্যায়-অনাচারের অপনোদনের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ছিলেন তৎপর। তিনি যে শান্তি ও মানবতার মুক্তির ম্যাসেজ ঘোষণা করেছিলেন, তা বিঘোষিত হয়েছে দেশ হতে দেশান্তরে। তাঁর প্রদত্ত শান্তি ও কল্যাণকর আলোকময় আভায় আলোকিত হয়েছে গোটা পৃথিবী তথা মানুষের ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন ও আন্তর্জাতিক জীবন। শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাঁর ‘হিলফুল ফুজুল’ গঠন ছাড়াও আরো শত-সহস্রাধিক দৃষ্টান্তের একটি ৬২৮ খ্রিস্টাব্দের ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’ স্থাপন, যা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় ছিল এক অনন্য-অনবদ্য মাইলফলক ও যুগান্তকারী আদর্শ-উপমা।
নারীর নিরাপত্তা ও অধিকার প্রদান :
তৎকালীন আরব সমাজে ‘নারীর অধিকার’ বলতে বোধহয় কোনো শব্দযুগলই ছিল না। সর্বদিক থেকে নারীরা ছিল বঞ্চিত-অবহেলিত, নির্যাতিত ও নিগৃহীত। কন্যাসন্তাকে জীবন্ত মাটিতে পুঁতা হতো, নারীদের অস্থাবর সম্পত্তি হিসেবে ভোগ করা হতো; তাদের ছিল না অর্থনৈতিক, সামাজিক, মানবিক কিংবা বিবাহ-সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত কোনো অধিকার। এমনসব অনাচার-অবিচারকে ধূলোয় মিশিয়ে রাসূল (সা.) নারীদেরকে সর্ববিদ মৌলিক মানবাধিকার প্রদান করেন, আর সমাসীন করেন নারীকে রাণীর আসনে। ঘোষণা করেছেন অমোঘ বাণী- ‘নারীর উপর যেমন রয়েছে পুরুষের অধিকার; তেমনি পুরুষের উপরেও রয়েছে নারীর অধিকার।’
শ্রমিকশ্রেণির মর্যাদা ও অধিকার :
শ্রমিকরা দেশ ও দশের, নগর ও সভ্যতার উন্নয়নে সদা কলুর বলদের ন্যায় ঘানি টানলেও, ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা প্রাপ্তিতে তারা চরমভাবে অবহেলিত-অবজ্ঞায়িত। রাসূল (সা.) তাদেরকে মানবতা ও মর্যাদার সম্মানিত আসনে সমাসীন করেছেন। তাদের মর্যাদায় ঘোষণা করেছেন, ‘শ্রমজীবী আল্লাহর বন্ধু।’ (বায়হাকী)
আবার, তিনি তাদের বৈধ উপার্জনের পরিশ্রম-সাধনাকে ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ’র সাথে তুলনা করেছেন। নিজ হাতে অর্জিত উপার্জনকে সর্বোত্তম উপার্জন আখ্যা দিয়ে তাদেরকে মহিমান্বিত করেছেন। এছাড়াও, তিনি তাদের অধিকার নিশ্চিতে বলেন, ‘শ্রমিকের পারিশ্রমিক এতটুকু হওয়া উচিত, যাতে তা তার ও তার পরিবারের ভরণপোষণের জন্য যথেষ্ট হয়।’ অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘শ্রমিকের মজুরি তার ঘাম শুকানোর পূর্বে দিয়ে দাও।’ (ইবনে মাজাহ)
এতিম ও বিধবাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা :
এতিম ও বিধবারা সমাজের অন্যতম অসহায়-অপমানিত ও নির্যাতিত-নিপীড়িত শ্রেণি। তাদের মুক্তি ও মর্যাদা প্রদানে রাসূল (সা.) নিজে তাদেরকে প্রতিপালন ও অধিকার প্রদান করেছেন এবং অন্যকেও তা করতে উৎসাহিত করেছেন। তিনি সে ঘরকে সর্বোত্তম ঘর বলেছেন, যে ঘরে এতিম লালন-পালন করা হয় এবং এতিমের সাথে উত্তম আচরণ করা হয়। রাসূল (সা.) এতিমের প্রতিপালনকারীর মর্যাদা বর্ণনায় স্বহস্তের দুটি আঙ্গুলকে উঁচু করে ইরশাদ করেন, ‘আমি ও এতিমের অভিভাবক বেহেশতে এভাবে পাশাপাশি থাকবো।’ (বুখারী)
আবার, স্বামীর সম্পদে বিধবার উত্তরাধিকারী সাব্যস্তকরণ ছাড়াও অধিক নিরাপত্তার নিমিত্তে তিনি পুনর্বিবাহ বন্ধনে বিধবাদের উৎসাহিত করেছেন। এছাড়াও তিনি বলেছেন, ‘বিধবা ও মিসকিনদের জন্য খাদ্য জোগাড়ে চেষ্টারত ব্যক্তি, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর মতো অথবা সারারাত ইবাদতকারী এবং দিনে রোজা পালনকারীর মতো’ (বুখারী)। তিনি এভাবে অসহায় এতিম-বিধবাদের মানবাধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছেন।
সাম্য প্রতিষ্ঠায় :
মানবতার শ্রেষ্ঠবন্ধু মুহাম্মদ (সা.) সামগ্রিক মানবকল্যাণ ও মুক্তির লক্ষ্যে এক অবিনাশী সাম্য-সম্প্রীতির বিপ্লবী বাণী নিয়ে আগমন করেছিলেন এই বসুন্ধরায়। তিনি জীবনের সর্বক্ষেত্রে ভারসাম্যপূর্ণ সমতা ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ভাষা-বর্ণ, ধর্ম-গোত্রের দুর্ভেদ্য দেয়াল এবং আশরাফ-আতরাফ, উচ্চ-নীচের দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীরকে তিনি ভেঙ্গে খান খান করে মানুষকে কেবল মানুষ পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। স্থাপন করেছিলেন তিনি সমাজের মানুষের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং আইনের ন্যায্য সাম্য ও সমতা। ‘বিদায় হজ্জের ভাষণে’ ঘোষণা করেছিলেন সাম্যের অমীয় বাণী- ‘কালোর উপর নেই সাদার মর্যাদা, নেই সাদার উপরে কালোর; তেমনি অনারবের উপরে নেই আরবের কর্তৃত্ব, নেই আরবের উপরে অনারবের।’
অমুসলিমদের অধিকার প্রতিষ্ঠা :
ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে নিয়ে ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা.) মানব ভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলেন। সমকালীন সকল ধর্মীয়-সামাজিক ভেদাভেদ উচ্ছেদ করে সকল মানুষকে এক আদমের (আ.) সন্তান হিসেবে মানব ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে গেঁথে দিয়েছিলেন তিনি। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় মুসলমান-অমুসলমান বলে কোনো পার্থক্য-প্রভেদ করেন নি। বরং মুসলমানের ন্যায় মানুষ হিসেবে অমুসলিমদের সম্মান-সম্পদের এবং জীবন ও ধর্মীয় পূর্ণনিরাপত্তা প্রদান করেছিলেন। পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান ‘মদিনার সনদ’-ই এর উৎকৃষ্ট উপমা। তিনি সদ্ব্যবহার ও আর্থিক-নৈতিক সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন অনেক অমুসলিকে, সেবা করেছেন তাদের অসুস্থতায়। এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ‘কুটনি বুড়ির ঘটনা’, যা বিশ্বইতিহাস ও স্মৃতির পাতায় আজো জ্বলজ্বল করছে।
বিদ্বেষী-বিরুদ্ধাচারণকারীদের সাথে মানবিক আচরণ :
রাসূল (সা.) শুধু মিত্রদের সাথেই নয়, চরম বিরুদ্ধবাদী-বিদ্বেষীদের সাথেও মানবিক আচরণ করতেন। তাগুত শক্তি যখন ইসলামকে অঙ্কুরেই ধরার ধূলিতে মিশিয়ে দিতে চেয়েছিল, তখন অনন্যোপায় হয়ে অস্থিত্ব রক্ষায় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। সে প্রতিরোধমূলক যুদ্ধের ময়দানে তিনি নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের হত্যা করতে নিষেধ করেছেন। অথচ তা ছিল তৎকালীন আরবদের রীতিবিরুদ্ধ। আবার, যুদ্ধক্ষেত্রে আরবরা পরাজিতদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে টুকরো টুকরো করে দিত, তাদের হাড় দ্বারা গলার হার বানাতো, শত্রুর মাথার খুলি দিয়ে শরাব পান করতো। উহুদ যুদ্ধে এমন বর্বরোচিত আচরণের শিকার স্বয়ং রাসূল সা. এর চাচা হামযা (রা.) হয়েছিলেন।
কিন্তু মানবতার বন্ধু প্রিয়নবী (সা.) যুদ্ধের ময়দানেও পরাজিত দুশমনদের অঙ্গচ্ছেদ ও অঙ্গবিকৃতি করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেন। এতে তিনি শুধু মানুষকেই নয়, মানুষের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে সম্মানিত করেছেন। এছাড়াও, চরম বিদ্বেষী ও বিরোধীদের সাথে মহামানব মুহাম্মাদ (সা.) এর মানবিক আচরণের সর্বশ্রেষ্ঠ ও বিশ্বের বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত হলো ‘মক্কা বিজয় শেষে সকলকে ক্ষমা ঘোষণা’।
মানুষের জীবনের নিরাপত্তা প্রদান :
ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মুসলিম-অমুসলিম সকল মানুষের জীবনের নিরাপত্তার অধিকার প্রদানে রাসূল (সা.) ছিলেন এক অনন্য বিরল-বিস্ময়কর আদর্শ ও উপমা। মানুষের জীবনের নিরাপত্তায় তাঁর মাধ্যমেই মানবহত্যাকে কঠোর ভাষায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একজন মানুষ হত্যাকে সমগ্র মানবজাতিকে হত্যার অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। মানবতার মহান বন্ধু মুহাম্মদ (সা.) কেবল দুনিয়ায় আগত মানবজীবনের নিরাপত্তাই দেননি, মায়ের গর্ভস্থ মানবসন্তানের জীবনেরও নিরাপত্তা দিয়েছেন। কুরআন কারীমের ভাষ্যমতে, ‘তোমরা দারিদ্রতার ভয়ে তোমাদের (গর্ভস্থ) সস্তানদের হত্যা করো না।’ (বনী ইসরাইল: ৩১)
আবার, শুধু অন্যকে হত্যা করাই অবৈধ নয়, আত্মহত্যাকেও হারাম ঘোষণা তথা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছেন। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা আত্মহত্যা করো না।’ (নিসা: ২৯)
অধিনস্তদের অধিকার রক্ষা :
তৎকালীন আরব সমাজে অধীনস্থ তথা দাস-দাসীদের সাধারণ মানুষের ন্যায় জীবনযাপনের অধিকার ও মর্যাদা ছিল না। দাসশ্রেণি ছিল সে যুগে সবচেয়ে নিপীড়িত, নিগৃহীত। তারাও যে মানুষ, তাদেরও যে মানবাধিকার আছে, আরবরা ভাবতেই পারতো না। রাসূল (সা.)-ই এমন হীন-অমানবিক দাসত্ব প্রথার আমূল সংস্কার সাধন করে দাসদাসী তথা অধীনস্থদের পূর্ণ মর্যাদা ও মানবাধিকার প্রদান করে বিশ্বে বিস্ময়বোধ জাগ্রত করেছিলেন। তিনি ক্রীতদাস যায়েদ বিন হারিসকে মুক্তি দিয়ে আপন পুত্র হিসেবে প্রতিপালন করেন। ক্রীতদাস বেলাল (রা.) কে ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন নিযুক্ত করে মহানবী (সা.) দাস-দাসী ও অধীনস্থদের যে মর্যাদা প্রদান করেছেন- তা বিশ্বইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে এবং থাকবে।
শুধু তাই নয়, দাস-দাসীদের মুক্তিদানকে শ্রেষ্ঠতর কাজ উল্লেখ করে তিনি বিদায় হজ্জের ভাষণে মানবতার বিস্ময়কর বাণী ঘোষণা করেছিলেন, ‘দাস-দাসী ও অধীনস্থরা তোমাদের মতোই মানুষ; সুতরাং তোমরা যা খাবে, তাদেরকে তা খাওয়াবে; তোমরা যা পরবে, তাদেরকে তা পরাবে। মনে রেখো, আল্লাহর নিকট সকলই সমান।’ এমন মানবতার সুমহান বাণী তিনি ব্যতীত এই পৃথিবীকে আর কে শুনিয়েছে?
ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় :
বিশ্বনবী (সা.) সকল শ্রেণির মানুষকে একই পদ্ধতিতে ন্যায় ও ইনসাফ লাভের অধিকার প্রদান করেছিলেন। নিজে ইনসাফের সর্বোত্তম আদর্শের নজির স্থাপন করেছিলেন। মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ (সা.) শিশুবেলায় যখন দুধমা হালিমার কাছে ছিলেন, সবসময় তিনি মা হালিমার কেবল ডানস্তনের দুধ পান করতেন। আর বাম স্তন তার অপর দুধ ভাইয়ের জন্য রেখে দিতেন। তাছাড়া, মুসলিম-অমুসলিম সকল মানুষ তাঁর দরবারে সর্বক্ষেত্রে সর্বদা ন্যায় ও ইনসাফ লাভ করতো। সুবিচার প্রতিষ্ঠায় তাঁর ঘোষণা ছিল এমন, ‘আমার মেয়ে ফাতেমাও যদি অপরাধ করে, তবে সেও অবশ্যই শাস্তি ভোগ করবে’। নবী করীম (সা.) ও খোলাফায়ে রাশেদার যুগে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অনেক ইহুদী-অমুসলিমের ইনসাফপূর্ণ বিচারপ্রাপ্তির অজস্র-সহস্র উপমা বিশ্বইতিহাসে রয়েছে।
ব্যক্তি স্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষা :
ইসলামের দৃষ্টিতে প্রত্যেক মানুষই স্বাধীন, এই স্বাধীনতা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক প্রদত্ত। আর প্রতিটি মানুষের কিছু একান্ত বিষয় থাকে, এই একান্ত বিষয়টি তার ব্যক্তিজীবনের মৌলিক অধিকার। মানবতার বন্ধু প্রিয়নবী (সা.) মানুষের এই মৌলিক অধিকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি মানুষের মতামত প্রকাশ ও যৌক্তিক সমালোচনার দিয়েছিলেন স্বাধীনতা । উহুদ যুদ্ধ পূর্বে তিনি মদিনার ভিতরে থেকে যুদ্ধ পরিচালনার কথা ব্যক্ত করলে কতিপয় যুবক সাহাবী মদিনার বাইরে যুদ্ধ করার মতামত পেশ করেন, রাসূল (সা.) তাদের মতামত ও পরামর্শের ভিত্তিতে মদিনার বাইরেই যুদ্ধের সংকল্প করেছিলেন। তিনি দিয়েছিলেন ধর্মবিশ্বাসের স্বাধীনতা, ঘোষণা করেছিলেন ঐশ্বরিক অমীয় বাণী, ‘ধর্মক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি বা জোর জবরদস্তি নেই’, ‘তোমাদের ধর্ম তোমাদের, আমাদের ধর্ম আমাদের’। এভাবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যক্তির মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করেছিলেন।
রাসূল (সা.) মানুষের গোপনীয়তা রক্ষা ও স্বাধীনতাকেও যথার্থ গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি অন্যের ঘরে উঁকি দিতে, বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করতে নিষেধ করেছেন; এমনকি মায়ের ঘরে সন্তানের প্রবেশকেও।
ঝগড়া-বিবাদের সুষ্ট সমাধান :
জাহেলি যুগে মানুষে মানুষে, গোত্রে গোত্রে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, খুনাখুনি, মারামারি, হানাহানি, কলহ-ঝগড়াবিবাদ সর্বদা লেগে থাকতো। এসবের অবসান ঘটিয়ে মানবতার বন্ধু প্রিয়নবী (সা.) মানুষকে ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে বর্বর সমাজকে করেন সোনালি-শান্তিময় সমাজ। নবুওত প্রাপ্তির পূর্বে পবিত্র কাবাগৃহে ‘হাজরে আসওয়াদ’ পুনঃস্থাপন নিয়ে আরবের গোত্রসমূহের মধ্যে দেখা দিয়েছিল- এক অবশ্যম্ভাবী রক্তক্ষয়ী সংঘাতের সম্ভাবনা। রাসূল (সা.) অতি বিচক্ষণতা ও প্রজ্ঞার সাথে সকল প্রতিনিধিকে নিয়ে একটি চাদরে করে ‘হাজরে আসওয়াদকে’ স্বহস্তে স্থাপন করেছিলেন। তাঁর সেই অনন্য সমাধান সকলেই সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নিয়েছিল এবং মানবতাবিধ্বংসী এক রক্তক্ষয়ী সংঘাত থেকে মানবজাতি পেয়েছিল মুক্তি। এরকম মানবতা বিধ্বংসী শত-সহস্র রক্তক্ষয়ী সংঘাত থেকে বিশ্বমানবতাকে রক্ষাকরণে অন্যতম আরেকটি উপমা হলো যুগ যুগ ধরে চলমান আউস-খাযরাজ দ্বন্দ্বের অবসান ঘটানো। আবার কলহ-দ্বন্দ্ব, ঝগড়া-বিবাদকে নিষিদ্ধ করে এর সমাধানে তিনি বলেন, ‘তিনদিনের অধিক সম্পর্ক ছিন্ন রাখা বৈধ নয়।’ প্রিয় পাঠক! মানবতাবোধের ক্ষেত্রে এর চেয়ে বড় দৃষ্টান্ত আর কী হতে পারে?
এভাবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর সমগ্রজীবনে রয়েছে মানবতার অজস্র আদর্শ ও দৃষ্টান্ত। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় তাঁর অমীয় বাণী ও সুমহান আদর্শ ছড়িয়ে পড়ুক দিগ্বিদিক-বিশ্বজুড়ে। কেননা, আজকের এই অশান্ত বিশ্বে শান্তি ফিরিয়ে আনতে একমাত্র পথ ও পন্থা হলো মানবতার বন্ধু বিশ্বনবী (সা.)-র সমগ্রজীবনের স্বর্গীয় আদর্শ ও দৃষ্টান্তের অনুসরণ ও অনুকরণ করা। তাঁর জীবনাদর্শ অনুকরণ-অনুসরণর করলেই আশা করা যায়- শান্তি ও কল্যাণের আলোয় আবারো আলোকিত হবে গোটা পৃথিবী, মানুষ পাবে তার পূর্ণ মৌলিক অধিকার। পরিশেষে কবির কবিতার মাধ্যমে মানবতার বন্ধু হিসেবে নবীজীবনের সিন্দুতে বিন্দুর ইতি টানছি…
“দিকে দিকে নতুন আলোর ছড়াক কারুকাজ
বিশ্বনবীর আদর্শে সোনালী সমাজ সাজ।”
লেখক: শিক্ষার্থী- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।