বিজয়ের সুদীর্ঘ পথের বাঁকেবাঁকে ইসলামি ভাবাদর্শ

-মনোয়ার কায়সার

 

আজ ১৬ই ডিসেম্বর, বাংলাদেশের বিজয় দিবস। নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের সোনালী ফসল ঘরে তোলা সম্ভব হয়েছিল এইদিনে। বিজয়ের এই ঐতিহাসিক দিনেই স্বাধীন ও সার্বভৌম বৃহত্তম মুসলিম দেশ হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশের।

প্রাচীন বঙ্গে ঈসায়ী সপ্তম শতক থেকেই ইসলামের সুমহান পয়গাম মানবতার সার্বজনীন আবেদন বুকে ধারণ করে আরব ভূখন্ড থেকে আসতে থাকেন মুসলিম ব্যবসায়ী ও নিবেদিত ধর্ম প্রচারক গণ। আরবের সাথে নৌপথই ছিল যোগাযোগের প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ পথ, তাই বঙ্গোপসাগরের কুলঘেঁষা এলাকাতেই প্রথমে এবং পরে ক্রমাগত অভ্যন্তর ভাগে তাঁরাই ইসলামের বাণী পৌঁছাতে থাকেন। ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ে ভারতে ইসলামী আদর্শ, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির খুব দ্রুতই প্রসার ঘটতে থাকে। প্রবহমান এই স্রোতধারায় তের শতকের শুরুতে বখতিয়ার খিলজি বাংলা জয় করেন।
বাংলার মানুষ ছিল দীর্ঘকাল অবহেলিত। এ দেশের আনার্য দ্রাবিড় এই জনগোষ্ঠীর ভাষাও ছিল অপাংতেয়। বর্ণভেদ প্রথার প্রবক্তারা ঘোষণা করেছিলেন এ দেশের মানুষের ব্যবহারিক ভাষায় শাস্ত্র চর্চা পাপ, এ পাপের সাজা রৌঢ়ব নামক নরকবাস। বর্ণভেদ আর অস্পৃশ্যতার অভিশাপে মানুষে মানুষে বিভেদের প্রাচীর মানবতার সূর্যকে আড়াল করে রেখেছিল, মনুষ্যত্বের এই চরম দুর্দিনে একদিকে মুসলিম শাসনে মানবিক উদার দৃষ্টিভঙ্গী, অন্য দিকে ওলি-দরবেশগণের তৌহিদি পয়গামে সবাইকে আপন করে বুকে তুলে নেয়ার নিপীড়িত বাংলার মানুষ খুঁজে পেল মুক্তির পথ, আলোর সন্ধান। “আল্লাহ ছাড়া আর কোনো প্রভু নেই, মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) তাঁর রাসূল “কালেমা এই উদাত্ত দাওয়াত ছিল এদের কাছে যুগান্তকারী আহ্বান। কালেমা পাঠের মাধ্যমে এরা সবাই দাঁড়াল এক কাতারে, বিভেদের প্রাচীর ধ্বংস হলো। বহু শতাব্দীর জুলুম ও নিষ্পেষণে ক্লান্ত এ দেশের মানুষ লাভ করল মানব মর্যাদা।
তের শতকের শুরু থেকে আঠার শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত মুসলিম শাসন ছিল বাংলায়। এ শাসন কখনো দিল্লিকেন্দ্রিক সুবেদারি, কখনো স্বাধীন সালতানাত। মুসলিম শাসনকালে ইসলামী আদর্শের অনুশীলন ছিল প্রধানত ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ। ওলি-দরবেশগণের দাওয়াতে আকৃষ্ট মুসলিম সমাজকে ইসলামী আদর্শে সুসংগঠিত করে রাষ্ট্রীয় কাঠামো ইসলামী আদর্শে ঢেলে সাজানোর তৎপরতা ছিল না। অবশ্য মাঝে মধ্যে কোনো কোনো সুলতানের আমলে বিচার ব্যবস্থায় ইসলামী শরিয়তের প্রবর্তন ওই সময়কালের উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। বস্তুত আর্দশ যতই সুন্দর হোক, সমষ্টিগতভাবে তাকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কার্যকর না করলে এই আর্দশ থেকে স্থায়ী ও ব্যাপক সুফল আশা করা যায় না।
পলাশী পরাজয় বাংলার আকাশে আনলো ঘন দুর্যোগ। মুসলিম সমাজ হারাল সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা। অর্থনৈতিকভাবে এদের মেরুদন্ড ভেঙে দেয়ার ষড়যন্ত্র সফল হয়েছিল। ডব্লিউ. ডব্লিউ হান্টার “দ্য ইন্ডিয়ার মুসলমানস” গ্রন্থে স্বীকার করেছেন, ১০০ বছর আগে মুসলিম সমাজ দরিদ্র ও অভাবী এটা ছিল অচিন্তনীয়; কিন্তু ১০০ বছর পর আজ মুসলিম সমাজ সচ্ছল ও বিত্তবান এটি অভাবনীয়। বস্তুত মুসলিম সমাজের এই চরম দুর্গতি ইংরেজ ও তার এ দেশীয় দোসরদের গভীর যড়যন্ত্রের ফল। শুধু বাংলাতে নয়, উপমহাদেশের সর্বত্রই মুসলিম সমাজের একই অবস্থা। এই সঙ্কটজনক পরিস্থিতির পরিবর্তন ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য বারবার চেষ্টা করা হয়েছে। মনের পর্দায় ছবির মতো ভেসে ওঠে পলাশীর প্রান্তর, বালাকোটের ময়দান, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা, হায়দার আলী, ফতেহ আলী টিপুর প্রতিরোধ, ফকির মজনুশাহ্ ও হাজী শরীয়তুল্লাহর তৎপরতা।
বাহ্যত পরিচয় যাই থাকুক না কেন, শোষকের কোনো জাত নেই। তারা সবাই শোষক এই তাদের পরিচয়। অপরের অধিকার হরণ করে নিজে স্বার্থসিদ্ধি তাদের বিবেকে বাধে না। বাংলার বুকে এই শ্রেণীর মানুষ যুগে যুগে সৃষ্টি করেছে বিপর্যয়, দুর্ভিক্ষ, ঘরে ঘরে ক্রন্দন উঠেছে অন্ন-বস্ত্রের অভাবে। এরা কখনো অত্যাচারী শাসক, কখনো এদের পরিচয় প্রতাপশালী জমিদার নায়েব-গোমস্তা, মুৎসুদ্দী, সুদী মহাজন, সামন্তবাদী শাসক।
উপমহাদেশের নিপীড়িত মুসলিম সমাজের সাথে বাংলার মুসলমানও স্বপ্ন দেখল স্বাধীন বাসস্থানের । এমন দেশে যেখানে সমাজও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা হবে নিশ্চিত; আর মুক্তির এই পথ ও নিশ্চয়তা আসবে মুসলিম লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের ঘোষণা মোতবেক ইসলামের সুমহান আদর্শ অনুসরণে। ভারত বিভক্তির বিঘোষিত নীতিমালার প্রেক্ষিতে জনসমষ্টির ধর্মীয় পরিচয়ের মানদন্ডে গোটা বাংলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যৌক্তিকতা রাখলেও রাজনৈতিক কুটনীতি ও মুসলিম বিদ্বেষের ষড়যন্ত্রে বাংলা হলো বিভক্ত। পূর্ববঙ্গ নামে সৃষ্টি হলো একটি প্রদেশ, যা আজ পরিচিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

সাতচল্লিশের দেশ ভাগের পর পাকিস্তনের সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী অধ্যুষিত এই এলাকা ন্যায়সঙ্গতভাবে অধিকারে হকদার ছিল যে ব্যবহার ও সম্পদের, ইতিহাস সাক্ষী প্রত্যাশিত সে ন্যায়বিচার ও ন্যায্য আধিকার এ দেশ পায়নি। কখনো রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে, কখনো বাঙালি – বিহারি সম্পর্ক নির্ণয়ে, কখনো সেনাবাহিনীতে লোক নিয়োগে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণে দিনের পর দিন ধূমায়িত হয়েছে অসন্তোষ, যার প্রচন্ড বহিঃপ্রকাশ ঊনসত্তর থেকে একাত্তরের শেষ অবধি। লাখ লাখ শহীদের রক্ত ঝরল এই বাংলাদেশ। শতকরা আটানব্বই ভাগ ভোট পেয়ে যে নেতৃত্ব ক্ষমতার হকদার হলো, তাকে ক্ষমতা অর্পণ করলে অকারণ রক্তক্ষয়ের বিষাদান্তিক নাটকের দৃশ্যগুলো এত মর্মান্তিক হতো না।
মুক্তিবাহিনী, সামরিক, আধা সামরিক বাহিনী ও এ দেশের জনগণ স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম করেছে। যারা ভাবলেন : পাকিস্তান বিভক্ত এই এলাকায় সৃষ্টি করবে বহিঃশক্তির আধিপত্যবাদ, এ দেশ হারাবে স্বকীয় স্বাধীন সত্তা, তারা সংগ্রামের স্বপক্ষে থাকতে পারেনি। যুদ্ধ চলাকালেই এঁদের অনেকের মতের পরিবর্তন ঘটে বাস্তব অবস্থার আলোকে। অনেকে পরিবর্তন এসেছে আরো পরে। ঢালাওভাবে এদের স্বাধীনতার শত্রু আখ্যায়িত করে মনে আত্মপ্রসাদ পাওয়া যেতে পারে হয়তো, কিন্তু মানুষের ধারণা ও চিন্তার বৈচিত্র্যের সঠিক মূল্যায়ন করা হয় না।
বাংলাদেশের মাটিতে জানা-অজানা মুক্তিযোদ্ধাদের কবরের পাশ দিয়ে হাঁটতে মন শোকাভূত হয়; প্রাণের তাজা রক্ত ঢেলে এরা এনেছে এই স্বাধীনতা, আমরা যার উত্তরাধিকারী। অন্য দিকে, এ দেশে এমন বহু লোকের মৃত্যুর করুণ কাহিনী শুনি, যারা বিদ্যমান কাঠামো বহাল থাকার সপক্ষে থাকলেও পাক বাহিনীর বর্বরতাকে সমর্থন করেনি কোনোদিন। এদের জন্যও চক্ষু অশ্রুসজল হয়ে ওঠে।
এ দেশের তৌহিদবাদী মানুষেরা আল্লাহর নাম নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা ইসলামের নির্দেশ- এই বিশ্বাস ছিল তাঁদের অন্তরে। নামাজ ও দোয়া দরুদ পাঠ করে নির্ভয়ে অপারেশনে যাত্রা; রাতের অন্ধকারে ঘরে ফিরে মাকে আল্লাহর কাছে মুনাজাত করার অনুরোধ, নফল নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, রোজা রাখার মাধ্যমে সন্তানের কোলে ফিরে আসার জন্য মায়ের মুনাজাত ও অশ্রুসজল কান্না, স্মরণকালে কালেমা পাঠ করে মুক্তিযোদ্ধার জীবনাবসান- এই ইতিহাস মিথ্যা নয়।
এই প্রান্তিকের বাইরে কিছু লোক এমন মর্মান্তিক দৃশ্যের অবতারণা করেছে যা শুনে মানবতা শিউরে ওঠে। সন্দেহের অক্টোপাশে জ্ঞানী-গুণী, অধ্যাপক, ডাক্তার, শিল্পী-সাংবাদিক, ইমাম, আলিম, মাওলানা বহু লোক প্রাণ হারালেন। মনুষ্যত্ব এখানে স্তব্ধবাক। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। প্রবল ঝঞ্ঝার শেষে সাগরের প্রশান্তি ছিল কাম্য। হয়তো তাই হতো। কেননা, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর সামান্য সময়ের জন্য শোনা গিয়েছিল কিছু লোক এ দেশকে মুসলিম বাংলা নামকরণের পক্ষপাতী, তাদের বক্তব্য ছিল এতে মুসলিম বিশ্বের সাথে যোগাযোগ হবে সুবিধাজনক। ধীরে ধীরে বাস্তবতা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে, এদের তৎপরতা বন্ধ হয়। এরা স্বীকার করে নেয়, এ দেশের নামকরণ।
দেশের আপামর সকল মানুষের মনে দেশের অস্তিত্ব ও সার্বভৌম সত্তার বিশ্বাস সুদৃঢ় হলেও প্রত্যাশিত শান্ত পরিবেশ বাংলায় আসেনি। রাষ্ট্রীয় আদর্শ নির্ণয়ে মত-পার্থক্য শিক্ষানীতির বারবার পরিবর্তন, ঘন ঘন রাজনৈতিক পট বদলানো দেশকে যুদ্ধোত্তর সুস্থ করে তোলায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কথা উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করেও বাস্তব ক্ষেত্রে আমরা তার অনুসরণে ব্যর্থ হয়েছি বারবার। জাতি হিসেবে আমরা বহুলাংশে অসহনশীল, অন্যের মতকে শ্রদ্ধা করতে শিখিনি, এর প্রমাণ দিয়েছি বারবার। মত-পাথর্ক্যরে এই তীব্রতা থাকলেও আমরা মনে করি বর্তমানে বাংলাদেশের সকল নাগরিক ভালোবাসে দেশকে। দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা বিপন্ন হোক এটা কারারোই কাম্য নয়।

লেখক– সহকারী অধ্যাপক, জকিগঞ্জ ফাযিল সিনিয়র মাদরাসা।